ওজন কমানোর উপায়

ওজন কমানোর উপায় ও শরীরচর্চার গুরুত্ব

ভূমিকা কেন ওজন কমানো জরুরি

বর্তমান যুগে স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রতি তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একজন ওজনজনিত সমস্যায় ভুগছে। অতিরিক্ত ওজন শুধু শরীরের সৌন্দর্য কমায় না, বরং ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রোগ, কিডনি সমস্যা, জয়েন্ট পেইনসহ নানা জটিল রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ সমস্যাটি ক্রমেই বাড়ছে। শহুরে জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর ফাস্টফুড খাওয়ার অভ্যাস, বসে বসে কাজ করা, পর্যাপ্ত শরীরচর্চার অভাব এবং মানসিক চাপ সব মিলিয়ে মানুষ দ্রুত মোটা হয়ে পড়ছে। অথচ ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে জীবনযাত্রার মান বাড়ে, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ ও সুখী জীবন পাওয়া সম্ভব

ওজন কমানো মানে শুধু খাওয়া কমানো নয়। বরং এটি হলো সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শরীরচর্চা, মানসম্মত ঘুম, পর্যাপ্ত পানি পান এবং মানসিক স্বাস্থ্যের সঠিক সমন্বয়

অধ্যায় ১। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন

খাদ্যাভ্যাস হলো ওজন কমানোর সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি। একটি প্রবাদ আছে:
Weight loss is 70% diet and 30% exercise
অর্থাৎ ওজন কমানোর ক্ষেত্রে খাদ্যের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি

১.১ সকালের নাস্তা

দিনের শুরুতে স্বাস্থ্যকর নাস্তা খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। যারা সকালের নাস্তা বাদ দেন, তারা দিনের বাকি সময়ে বেশি খেয়ে ফেলেন

খাওয়ার তালিকায় রাখতে পারেন

·        ডিমের সাদা অংশ (প্রোটিন সমৃদ্ধ, কম ক্যালরি)

·        ওটস বা ব্রাউন ব্রেড (ফাইবার বেশি, হজম ভালো হয়)

·        মৌসুমি ফল (আপেল, কলা, পেয়ারা, কমলা)

·        চিনি ছাড়া গ্রিন টি বা ব্ল্যাক কফি (মেটাবলিজম বাড়ায়)

এড়িয়ে চলতে হবে

·        পরোটা, সিঙ্গারা, সমুচা, আলুর চপ

·        চা কফিতে অতিরিক্ত চিনি

·        সফট ড্রিঙ্কস বা ফিজি ড্রিঙ্কস

১.২ দুপুরের খাবার

দুপুরের খাবারে ভাত আমাদের প্রধান উপাদান হলেও, ভাত অতিরিক্ত খেলে দ্রুত ফ্যাট জমে

খাওয়ার তালিকা

·        অর্ধেক ভাত বা ১-২ রুটি

·        বেশি পরিমাণে সবজি (ফাইবার বাড়ায় ও পেট ভরা রাখে)

·        মাছ, মুরগি বা ডাল (প্রোটিন যোগ করে, ওজন কমাতে সাহায্য করে)

·        লেবুর পানি বা দই (হজম ভালো করে)

এড়িয়ে চলতে হবে

·        অতিরিক্ত ভাত, ভাজা খাবার, ঝালতেলযুক্ত তরকারি

·        সফট ড্রিঙ্কস বা মিষ্টি খাবার

ভাত খাওয়ার আগে এক বাটি স্যালাড খেলে ক্ষুধা কমে যায় এবং স্বাভাবিকভাবে কম ভাত খাওয়া হয়

১.৩ বিকেলের নাস্তা

অনেকেই বিকেলে চা বিস্কুট বা ফাস্টফুড খান। এখানেই আসল ভুল হয়

স্বাস্থ্যকর নাস্তা হতে পারে

·        ফল (আপেল, কমলা, পেঁপে, আঙ্গুর)

·        বাদাম (কাঠবাদাম, আখরোট, কাজু)

·        চিনি ছাড়া গ্রিন টি বা ব্ল্যাক কফি

বাদ দিতে হবে

·        বিস্কুট, চিপস, কোল্ড ড্রিঙ্কস, বেকারি আইটেম

·        ঝাল ঝাল নুডলস বা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই

১.৪ রাতের খাবার

ওজন কমাতে চাইলে রাতের খাবার হতে হবে সবচেয়ে হালকা

খাওয়ার তালিকা

·        ভাতের বদলে স্যালাড সবজির স্যুপ

·        সামান্য মাছ বা মুরগি

·        ডাল বা ছোলা

চেষ্টা করুন রাত ৮টার মধ্যে ডিনার শেষ করতে

এড়িয়ে চলতে হবে

·        ভাত, আলু, ভাজা খাবার

·        অতিরিক্ত মিষ্টি

১.৫ সাধারণ টিপস (খাদ্যাভ্যাস)

·        দিনে ৪-৫ বার ছোট ছোট মিল খান, একসাথে অনেক খাওয়া ঠিক নয়

·        রান্নায় তেলের ব্যবহার কমান, চাইলে প্রতিদিন ১ চামচ অলিভ অয়েল বা সরিষার তেল ব্যবহার করুন

·        বাজারজাত জুস, চকোলেট, ফাস্টফুড, ডিপ ফ্রাই আইটেম পুরোপুরি বাদ দিন

·        খাবারের সাথে পর্যাপ্ত পানি পান করুন, তবে খাওয়ার সময় নয় বরং খাওয়ার আগে ও পরে

অধ্যায় ২। নিয়মিত শরীরচর্চা

ডায়েট পরিবর্তন শুধু অর্ধেক কাজ করে, বাকি অর্ধেক হলো ব্যায়াম। শরীরচর্চা ক্যালরি পোড়ায়, পেশি গঠন করে এবং মেটাবলিজম দ্রুত করে

২.১ কার্ডিও এক্সারসাইজ

কার্ডিও হলো এমন ব্যায়াম যা হার্টবিট বাড়ায় এবং ক্যালরি দ্রুত পোড়ায়

জনপ্রিয় কার্ডিও এক্সারসাইজ:

·        দ্রুত হাঁটা (৩০ মিনিট)

·        জগিং বা দৌড়ানো

·        সাইক্লিং

·        জাম্প রোপ (দড়ি লাফ)

সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন, প্রতিদিন ৩০-৪৫ মিনিট কার্ডিও করলে মাসে ১-২ কেজি ওজন কমানো সম্ভব

২.২ স্ট্রেংথ ট্রেনিং

অনেকে মনে করেন শুধু কার্ডিও করলেই হবে। কিন্তু স্ট্রেংথ ট্রেনিং করলে পেশি বাড়ে, আর পেশি বাড়লে শরীর বেশি ক্যালরি বার্ন করে

ঘরে বসে করা যায় এমন স্ট্রেংথ এক্সারসাইজ

·        স্কোয়াট

·        পুশ আপ

·        প্ল্যাঙ্ক

·        লাঞ্জ

সপ্তাহে ২-৩ দিন ২০-৩০ মিনিট স্ট্রেংথ ট্রেনিং করলে শরীর টোনড হয়

২.৩ যোগব্যায়াম ও মেডিটেশন

যোগ শুধু ফিটনেস নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও অসাধারণ

·        স্ট্রেস কমায়

·        হরমোন ঠিক রাখে

·        অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমায়

ওজন কমানোর জন্য জনপ্রিয় যোগ আসন: সূর্য নমস্কার, কপালভাতি, ভুজঙ্গাসন, শবাসন

অধ্যায় ৩। পানি পান ও হাইড্রেশন

শরীরের ৭০% অংশ পানি। পর্যাপ্ত পানি না খেলে ওজন কমানো প্রায় অসম্ভব

৩.১ পানি পানের উপকারিতা

·        শরীরের টক্সিন বের করে দেয়

·        ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে

·        মেটাবলিজম বাড়ায়

৩.২ টিপস

·        দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন

·        খাওয়ার আগে ১ গ্লাস পানি পান করলে ক্ষুধা কম লাগে

·        সফট ড্রিঙ্কস, এনার্জি ড্রিঙ্কস, চিনি দেওয়া জুস এড়িয়ে চলুন

অধ্যায় ৪। ঘুম ও বিশ্রাম

ঘুম ওজন কমানোর একটি অদৃশ্য অস্ত্র

৪.১ কেন ঘুম জরুরি?

·        পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীরে Leptin & Ghrelin হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়

·        রাতে জাগলে ক্ষুধা বেশি লাগে বেশি খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে

৪.২ টিপস

·        প্রতিদিন ৬-৮ ঘণ্টা ঘুমান

·        নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো ও জাগা অভ্যাস করুন

·        মোবাইল-টিভি ব্যবহার কমান রাতে

অধ্যায় ৫। মানসিক স্বাস্থ্য ও স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট

ওজন শুধু শরীরের বিষয় নয়, মনের সাথেও সম্পর্কিত

৫.১ স্ট্রেসের কারণে কেন ওজন বাড়ে?

·        Cortisol নামের হরমোন বেড়ে যায়

·        বেশি ক্ষুধা লাগে

·        Junk food খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে

৫.২ করণীয়

·        প্রতিদিন ১৫ মিনিট মেডিটেশন করুন

·        গান শুনুন, বই পড়ুন

·        যোগব্যায়াম করুন

·        পরিবার-বন্ধুর সাথে সময় কাটান

অধ্যায় ৬। ছোট ছোট লক্ষ্য ও সতর্কতা

৬.১ ছোট লক্ষ্য

·        মাসে ২-৩ কেজি কমানো নিরাপদ

·        প্রতিদিন অগ্রগতি মাপুন (ওজন মেশিন + কোমর মাপ)

৬.২ সতর্কতা

ক্রাশ ডায়েট করবেন না  শরীর দুর্বল হয়ে যাবে
ওষুধ বা সাপ্লিমেন্টে নির্ভর করবেন না  পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে
স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে (ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, হার্ট ডিজিজ) অবশ্যই ডাক্তার/ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিন

মনে রাখবেন

ওজন কমানো মানে কষ্ট বা বঞ্চনা নয়। বরং এটি হলো সঠিক ডায়েট + নিয়মিত শরীরচর্চা + পর্যাপ্ত ঘুম + মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন
ধীরে ধীরে প্রতিদিনের অভ্যাস বদলালেই দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ ও ফিট থাকা সম্ভব

Post a Comment

0 Comments